হযরত ফাতিমা'র গৃহে আগুন ও হযরত আলী'র বাইয়াত গ্রহণ

সুন্নী তথ্যের ভিত্তিতে "হযরত ফাতিমা'র গৃহে আগুন ও হযরত আলী'র বাইয়াত গ্রহণ"।

ইসলামের ইতিহাসের এ অংশটুকু সবচেয়ে তিক্ত ও বেদনাদায়ক অধ্যায়ের অন্তরভুক্ত যা জাগ্রত ও সচেতন অন্তরগুলোকে নির্মমভাবে যন্ত্রনাকাতর করে তোলে এবং শোক্তাপে পুড়িয়ে মারে। ইতিহাসের এ অংশটি আহলে সুন্নাতের মনীষীগণ সংক্ষেপে ও ছোট কলেবরে তাদের গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ করেছেন, আর শিয়া মনীষীগণ সবিস্তারে তা বর্ণনা করেছেন। সম্মানিত পাঠকদের মধ্যে হয়তো এমন কেউ থাকতে পারেন যারা ওহীর ঘরে আক্রমন করার কাহিনীকে আহলে সুন্নাতের হাদীসবেত্তা ও ইতিহাস লেখকদের মুখ থেকে শুনতে চান। একারণে, এ অংশটুকু তাদের সূত্রাবলী ও দলীল প্রমাণের ওপর নির্ভর করেই লিখব যাতে সন্দেহপ্রবন ও বিলম্বে বিশ্বাসী ব্যক্তিরাও এ তিক্ত ঘটনাবলীর কথা বিশ্বাস করতে পারে। এ ব্যাপারে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে কুতাইবা দীনাওয়ারী তাঁর “আল-ইমামাহ ওয়াস-সীয়াসাহ” গ্রন্থে যা বর্ণনা করেছেন এখানে আমরা তার অনুবাদ উল্লেখ করছি। আর এ বিষয়ে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের কাজটি পরবর্তী অংশে তুলে ধরা হবে।

আহলে সুন্নাতের লেখকগণ এ ব্যাপারে একমত যে, তখনো সাক্কীফার বাইয়াতের পর বেশী সময় অতিবাহিত হয় নি, এমন সময় খলিফার পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, হযরত আলী(আঃ), আব্বাস, যুবাইর ও বনী হাশেমের অন্যান্য লোকের কাছ থেকে আবু বকরের খেলাফতের অনুকুলে বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে যাতে তাঁর খেলাফত ঐক্য ও সর্বসম্মত রুপ লাভ করে এবং এর ফলে খেলাফতের পথ থেকে সর্বপ্রকার অন্তরায় ও বিরোধিতা অপসারিত হয়ে যায়।

সাক্কীফার ঘটনার পর বনী হাশিম ও মুহাজিরদের একটি দল ও ইমাম আলীর(আঃ) ভক্তবৃন্দ প্রতিবাদস্বরুপ হযরত ফাতিমার(আঃ) ঘরে আশ্রয় নেন। হযরত ফাতিমার(আঃ) ঘরে-যা রাসুলের(সাঃ) যামানায় বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিল-তাঁদের আশ্রয় গ্রহণ, খেলাফতের পক্ষে সেখানে আক্রমন চালানো এবং তাঁদেরকে জোরপুর্বক মসজিদে হাজির করে তাঁদের কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণের পরিকল্পনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা বিস্তারের মোহ যা করার তা-ই করে বসলো। ওহীর ঘরের মর্যাদা উপেক্ষা করা হলো।খলিফা আবু বকর হযরত ফাতিমার(আঃ) ঘরে আশ্রয় গ্রহণকারীদের কাছ থেকে বাইয়াত আদায়ের উদ্দেশ্যে তাঁদেরকে যেকোন মুল্যে সেখান থেকে বের করে আনার উদ্দেশ্যে একদল লোক নিয়ে সেখানে যাবার জন্য ওমরকে নির্দেশ দিলেন। ওমর এ আদেশ পেয়ে উসাইদ ইবনে হুযাইর, সালমাহ ইবনে সালামাহ, ছাবেত ইবনে কায়েস ও মুহাম্মাদ ইবনে মুসলিমাহসহ একদল লোককে নিয়ে ফাতিমার(আঃ) গৃহ অভিমুখে যাত্রা করলেন। উদ্দেশ্য, সেখানে আশ্রয় গ্রহণকারীদেরকে খলীফার হাতে বাইয়াত হবার জন্য আহবান জানানো, আর আহবানে সাড়া না দিলে তাঁদেরকে জোর করে ঘর থেকে বের করে এনে মসজিদে হাজির করানো ।

খলিফার আজ্ঞাবাহী(ওমর) হযরত ফাতিমার(আঃ) ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বললেনঃ “ঘরে আশ্রয় গ্রহণকারীরা! যত শীঘ্র সম্ভব খলিফার হাতে বাইয়াত হবার জন্য ঘরের ভিতর থেকে বের হয়ে এসো।“ কিন্তু তার হুঙ্কার ও চিৎকারে কোন লাভ হলো না। কেউ ঘর থেকে বের হলো না।

খলিফার আজ্ঞাবাহী (ওমর) এসময় ঘরে আগুন দেয়ার জন্য কাঠ আনতে বললো যাতে আশ্রয় গ্রহণকারীরদের মাথার উপরেই ঘরটি জ্বলে যায়। তাঁর সঙ্গীদের মধ্য থেকে একজন এগিয়ে এসে খলিফার আজ্ঞাবাহীকে এ অপরাধকর্ম থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করলেন এবং বললেন, “ আপনি কিভাবে এ ঘরে আগুন জ্বালাতে পারেন যখন নবী দুলালী হযরত ফাতিমা(আঃ) এর মধ্যে অবস্থান করছেন? উত্তরে তিনি ঠান্ডা মাথায় বললেন, “ঘরের ভিতর ফাতিমার অবস্থান এ কাজে বাধা হবে না।“

এসময় ফাতিমা(আঃ) দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে বললেনঃ

“আমি এমন কোন সমষ্টিকে দেখিনি যারা কখনো তোমাদের মতো নিকৃষ্ট অবস্থায় পতিত হয়েছে। তোমরা রাসুলুল্লাহর(সাঃ) লাশকে আমাদের মাঝে ফেলে রেখে গেছো এবং নিজেরা মিলে খেলাফত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছো। কেন তোমরা তোমাদের ফয়সালা আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছ, আর খেলাফত আমাদের ন্যায্য অধিকার তা আমাদের ফিরিয়ে দিচ্ছ না” ?

ইবনে কুতায়বা বলেনঃ

এ দফায় খলিফার আজ্ঞাবাহী আশ্রয় গ্রহণকারীদেরকে ঘর থেকে বের করে আনার কাজ থেকে সরে এলেন এবং খলিফার কাছে উপস্থিত হয়ে সব কথা তাকে অবগত করালেন। খলিফা যেহেতু জানতেন যে, আশ্রয় গ্রহণকারীরা বনী হাশেমের এবং আনসার ও মুহাজিরদের মধ্য থেকে এমন সব বিশিষ্ট ব্যক্তি যাদের বিরোধিতা থাকলে তার হুকুমতের ভিত্তি দৃঢ় ও মজবুত হবে না, এ কারণে এবার তিনি তার গোলাম কুনফুযকে পাঠালেন আলীকে(আঃ) মসজিদে নিয়ে আসার জন্য।সে-ও দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো এবং আলীকে(আঃ) ডাক দিয়ে বললো, “আপনাকে রাসুলাল্লাহর(সাঃ) খলিফার নির্দেশে মসজিদে যেতে হবে”
আলী(আঃ) যখন কুনফুযের এ কথা শুনলেন তখন বললেন, “তোমরা এতো শীঘ্রই কেন রাসুলুল্লাহর(সাঃ) নামে মিথ্যা রচনা করলে? রাসুলুল্লাহ(সাঃ) কখন তাকে স্বীয় খলিফা নির্ধারন করলেন যে, তিনি রাসুলুল্লাহর(সাঃ) খলিফা হবেন?” গোলাম নিরাশ হয়ে ফিরে গেলো এবং খলিফাকে ঘটনা অবগত করালো।

খেলাফতের পক্ষ থেকে আসা আহবান আশ্রয় গ্রহণকারীদের দ্বারা বারবার প্রত্যাখ্যাত হবার কারনে খলিফা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। অবশেষে হযরত ২য় বারের মত একদল লোককে সঙ্গে নিয়ে হযরত ফাতিমার(আঃ) ঘরে হাজির হলেন। নবী কন্যা যখন আক্রমনকারীদের শব্দ শুনতে পেলেন তখন দরজার পিছনে উচ্চঃস্বরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং বললেনঃ

“বাবা! হে আল্লাহর নবী! আপনার ইন্তেকালের পর ইবনে খাত্তাব আর ইবনে কুহাফার দ্বারা আমরা এ কি বিপদে আক্রান্ত হলাম!“

হযরত ফাতিমা(আঃ)-যিনি তখনো পিতৃবিয়োগের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি, তাঁর এ মর্মবিদারী ক্রন্দন শুনে হযরত ওমরের সাথে আসা একদল লোক ফাতিমার(আঃ) ঘরে আক্রমন করা থেকে বিরত থাকে এবং সেখান থেকেই কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যায়।

কিন্তু হযরত ওমর ও বাদ বাকী লোকেরা- যারা আলী(আঃ) ও বনী হাশেমের কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহনের জন্য পীড়াপীড়ি করছিল, তারা বল প্রয়োগ করে হযরত আলীকে(আঃ) ঘর থেকে বের করে আনলো এবং হযরত আবুবকরের হাতে বাইয়াত গ্রহনের জন্য চাপ সৃষ্টি করলো। হযরত আলী(আঃ) বললেন, “যদি বাইয়াত না হই তাহলে কি হবে?" তারা বললো: “তাহলে নিহত হবেন”। হযরত আলী(আঃ) বললেন, ”কোন সাহসে তোমরা আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসুলের ভাইকে হত্যা করবে?”

হযরত আলীর(আঃ) তীব্র বাধা ও প্রতিরোধের মুখে খলিফার লোকজন বাধ্য হয়ে তাঁকে নিজের অবস্থায় ছেড়ে দিল। ইমাম আলী(আঃ) এ সুযোগ কাজে লাগালেন এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে নালিশ হিসাবে রাসুলুল্লাহর কবরের কাছে গেলেন। সেখানে তিনি হযরত হারুন(আঃ) হযরত মুসাকে(আঃ) যে বাক্যটি বলেছিলেন সেই কথাটি উচ্চারন করলেনঃ

“হে ভাই! (আপনার অবর্তমানে) এই দলটি আমাকে অসহায় করে ফেলেছে এবং আমাকে প্রায় হত্যা করে ফেলেছিল” (সুরা আল-আরাফঃ১৫০। আল-ইমামাহ ওয়াস-সিয়াসাহ, ১ম খন্ড, পৃঃ১২-১৩)।

ওহীর ঘরে আক্রমন সম্পর্কে ইতিহাসের বিচারঃ
সাক্কীফার পরবর্তী ঘটনাবলী ইসলামের ইতিহাসের এবং আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী'র(আঃ) জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও তিক্তকর ঘটনার মধ্যে একটি।এক্ষেত্রে সত্য প্রকাশ করা হলে ও খোলামেলা কথা বলা হলে তা একদল লোকের বিরক্তির কারন হয়-যারা এসব ঘটনার স্রষ্টা ও নিয়ন্তাদের ব্যাপারে ভক্তিতে গদ্গদ হয়ে যথাসম্ভব চেষ্টা করে যাতে তাদের গায়ে কোন রকম কালিমা স্পর্শ না করে এবং তাদের পাক-পবিত্রতা বজায় থাকে, যদিও সত্যকে গোপন করা এবং তা উল্টো করে প্রকাশ করে ইতিহাস ও ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতি একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা মাত্র।একজন সত্যনিষ্ট, বস্তুনিষ্ট ও স্বাধীন লেখক কখনো সত্যকে পদদলিত করেন না।

আরও পড়ুনঃ আলীকে কেন আঃ বলে শিয়ারা ?

হযরত আবু বকরের খেলাফতে অধিষ্টিত হবার পর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো ওহীর ঘরে এবং ফাতিমার(আঃ) ঘরে আক্রমন চালানো। যে আক্রমনের উদ্দেশ্য ছিল ফাতিমার ঘরে আশ্রয় গ্রহনকারীদের থেকে বা্ইয়াত আদায়ের জন্য তাঁদেরকে মসজিদে হাজির করা। এ বিষয়ের সঠিক ব্যাখ্যা ও মুল্যায়নের জন্য সঠিক ও নির্ভরযোগ্য সুত্রাবলীর ওপর নির্ভর করে নিম্নোক্ত ৩টি বিষয়ের সত্যাসত্য যাচাই করা আবশ্যক।

বিষয় ৩টি হলোঃ

১/ এটা কি সঠিক যে, খলিফার লোকজন হযরত ফাতিমার(আঃ) ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে? এপথে তারা কতদূর অগ্রসর হয়?

২/এটা কি সঠিক যে, আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলীর(আঃ) কাছ থেকে বাইয়াত আদায় করার জন্য তাঁকে নির্মম ও হৃদয়বিদারকভাবে মসজিদে নিয়ে যায়?

৩/এটা কি সঠিক যে, এ আক্রমনকালে নবী দুলালী হযরত ফাতিমা(আঃ) আক্রমনকারীদের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং এর ফলে তাঁর গর্ভপাত ঘটে তাঁর গর্ভস্থ সন্তান মারা যায়?

এ ৩টি বিষয় হলো এ ঘটনার সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়। আমরা আহলে সুন্নাতের মনীষীদের সঠিক ও নির্ভরযোগ্য সূত্রাবলীর সাহায্যে এগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করবো।

ইসলামের একটি জীবন্ত শিক্ষা হলো, কোন মুসলমান পূর্ব-অনুমতি না গ্রহণ করা পর্যন্ত কারো ঘরে প্রবেশ করবে না। আর গৃহকর্তা যদি অপারগতা প্রকাশ করে এবং অতিথি গ্রহনে সম্মত না হয় তাহলে তা মেনে নেবে এবং তাকে বিরক্ত না করে সেখান থেকে ফিরে আসবে (সূরা আন-নুরঃ২৭-২৮)

কোরআন মজীদ উপরোক্ত এ চারিত্রিক নির্দেশনা ছাড়াও যে ঘরে সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয় এবং তাঁর ইবাদাত করা হয় সেটাকে সম্মানিত বলে গন্য করেছে। এরশাদ হচ্ছেঃ

“আল্লাহ যেসব ঘরকে মর্যাদায় উন্নিত করা এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারন করার আদেশ দিয়েছেন, সেখানে সকাল সন্ধ্যায় তাঁর মহিমা ঘোষনা করে।“(সুরা আন-নুরঃ৩৬।

অনেক মুফাসসিরই বলেছেন যে, এ আয়াতে মসজিদের কথা বলা হয়েছে, অথচ ব্যাপার হচ্ছে, মসজিদ এধরনের ঘরের অন্যতম ও সর্বোত্তম উদাহরন, এধরনের একমাত্র ঘর নয়।

এসব ঘরের সম্মানের কারন হলো আল্লাহর সেই ইবাদাত ও স্মরন যা এগুলোর মধ্যে করা হয় এবং সেই সকল ঐশী ব্যক্তিদের কারনে যারা এর মধ্যে আল্লাহর মহিমা ও প্রশংসায় রত থাকেন। নতুবা কাঠ আর কাদামাটির কখনো সম্মান ছিল না, থাকবেও না।

মুসলমানদের সকল ঘরের মধ্য থেকে কোরআন মজীদ রাসুলাল্লাহর(সাঃ) ঘরের ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশ প্রদান করেছে। এরশাদ হচ্ছেঃ

“হে মুমিনগন! তোমাদেরকে অনুমতি দেয়া না হলে নবীর ঘরে প্রবেশ করো না।“(সুরা আল-আহযাবঃ৫৩)।

নিঃসন্দেহে হযরত ফাতিমার(আঃ) ঘরও সম্মানার্হ ও উন্নীত ঘরসমুহের অন্যতম ছিল যেখানে ফাতিমা যাহরা(আঃ) ও তাঁর সন্তানবর্গ আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষনা করতেন। এটা বলা যাবে না যে, হযরত আয়েশা বা হাফসার ঘর রাসুলাল্লাহর(সাঃ) ঘর ছিল। কিন্তু তাঁর মহীয়সী দুলালী বিশ্বের নারীকুল শ্রেষ্ট, তাঁর ঘর নিশ্চিতভাবে রাসুলাল্লাহরই(সাঃ) ঘর।

এখন দেখা যাক খলিফার লোকজন রাসুলাল্লাহর(সাঃ) এ ঘরটিকে কিভাবে রক্ষা করেছিল। খেলাফতের প্রথম দিনগুলোর ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, খলিফার লোকজন এসব আয়াতের সবগুলোর নির্দেশই অমান্য করে এবং রাসুলাল্লাহর(সাঃ) ঘরের মর্যাদা মোটেও রক্ষা করেনি।

আহলে সুন্নাতের ঐতিহাসিকবৃন্দের অধিকাংশই ওহীর ঘরে আক্রমনের ঘটনা অষ্পষ্টরুপে আর তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ কিছুটা ষ্পষ্টরুপে লিপিবদ্ধ করেছেন।

ত্বাবারী-যিনি খলিফাদের প্রতি বিশেষভাবে দুর্বল, তিনি শুধু এতটুকু লিখেছেন যে, হযরত ওমর একদল লোককে নিয়ে হযরত ফাতিমা যাহরার(আঃ) ঘরের সামনে আসেন ও বলেন, ”আল্লাহর শপথ, আমি এঘর জ্বালিয়ে দেবো যদি না আশ্রয় গ্রহনকারীরা বাইয়াত হবার জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে” (তারিখে ত্বাবারী,৩য় খন্ড,পৃঃ)।

কিন্তু ইবনে কুতায়বা দীনওয়ারী আরো বেশী পর্দা উন্মোচন করেছেন এবং বলেনঃ “সেই আল্লাহর শপথ যার হাতে ওমরের প্রাণ, হয় ঘর ছেড়ে বের হবে, না হয় তাতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেবো”। যখন তাকে বলা হলো যে নবী দুলালী হযরত ফাতিমা যাহরা(সাঃ) এ ঘরের মধ্যে রয়েছেন তখন তিনি বললেন, “থাকুক”। (আল-ইমামাহ ওয়াস-সীয়াসাহ, ২য় খন্ড, পৃঃ১২; শরহে নাহজুল বালাগাহঃইবনে আবীল হাদীদ, ১ম খন্ড, পৃঃ১৩৪; আ’লামুন নিসা, ৩য় খন্ড, পৃঃ১২০৫)।

‘ইক্কদুল ফারীদ গ্রন্থের রচয়িতা(ইবনে আব্দে রাব্বিহ আন্দালুসী, ওফাত ৪৯৪হিজরী) আরো এক ধাপ অগ্রসর হয়ে বলেনঃ

খলিফা হযরত ওমরকে দায়িত্ব প্রদান করেন যে, (হযরত ফাতিমা'র ঘরে) আশ্রয় গ্রহনকারীদের সে ঘর থেকে বের করে আনবেন, আর তাঁরা যদি প্রতিরোধ গড়ে তুলেন তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন।একারনে হযর ওমর ঘর পুড়িয়ে দেয়ার জন্য আগুন আনলেন। এ সময় তিনি হযরত ফাতিমার মুখোমুখি হন। নবী দুলালী বললেন, “হে ইবনে খত্তাব! আমাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতে এসেছো?” তিনি বললেন, “হ্যা, যদি না তারা অন্যদের মতো খলিফার হাতে বাইয়াত হয়।“ (ইক্কদুল ফরীদ, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ২৬০। আরো দেখুনঃতারিখে আবুল ফিদা, ১ম খন্ড, পৃঃ১৫৬; আলামুন নিসা, ৩য় খন্ড, পৃঃ১২০৭)।

আমরা যখন একই বিষয়ে শিয়া আলেমদের গ্রন্থে দেখবো তখন ঘটনা আর ষ্পষ্ট ও পরিপূর্ণরুপে দেখতে পাবো। সুলাইম ইবনে কায়েস( সুলাইম বিন ক্কায়স কুফী তাবেইন গনের অন্যতম। তিনি আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলীর(আঃ) যুগ থেকে শুরু করে ইমাম সাজ্জাদের(আঃ) যুগ পর্যন্ত দেখেছেন। তিনি হিজরী ৯০ সালে ইন্তেকাল করেন) তাঁর গ্রন্থে ওহীর ঘরে আক্রমনের ঘটনাকে সবিস্তারে লিখেছেন এবং সত্যের উপর থেকে পর্দা অপসারিত করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ

“খলিফার আজ্ঞাবাহী আগুন প্রজ্বলিত করলেন এবং তারপর দরজার ওপর ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন। কিন্তু তিনি হযরত ফাতিমার(আঃ) প্রতিরোধের সম্মুখীন হলেন”। (আছলু সুলাইম, পৃঃ৭৪, নাজাফ থেকে মুদ্রিত)।

তথ্যসূত্র:
(বইঃবেলায়েতের দ্যুতি, লেখকঃআয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী)
(সংকলিত)


Subscribe Our Youtube Channel

Disqus Comments